অর্থপাচার বনাম পদ্মা সেতু স্বর্গের পথ

Passenger Voice    |    ০৩:২৬ পিএম, ২০২২-০৬-১৫


অর্থপাচার বনাম পদ্মা সেতু স্বর্গের পথ

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পদ্মা সেতু অতিক্রম ‘স্বর্গে’ যেতে চাইছেন। ঢাকায় এক সমাবেশ তিনি বলেছেন, ‘আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, রাজপথে স্লোগান দিতাম, তখন ১০ টাকা তেলের দাম হয়ে গিয়েছিল। তখন আমরা বলতাম, ১০ টাকার তেল খেয়ে স্বর্গে যাব। এখন বলতে চাই ওই ব্রিজের (পদ্মা সেতু) টোল দিয়ে এবং পদ্মা ব্রিজ দিয়ে স্বর্গে যাব।’

জাতীয় সংসদে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা বলেন, পদ্মা সেতু দুর্নীতির টেক্সটবুক এক্সাম্পল হয়ে থাকবে। একই রকম বা একটু বেশি দৈর্ঘ্যরে সেতুর সঙ্গে পদ্মা সেতুর তুলনা করলে পদ্মা সেতুকে গোল্ডেন ব্রিজ বলতেই পারি।

বাংলাদেশে বিদেশে অর্থপাচার আলোচিত বিষয়। কালো টাকা নিয়েও অনেক কথা হয়। ব্ল্যাক ইকোনমি কেবল বাংলাদেশে নয়, অনেক দেশে রয়েছে। ব্ল্যাক মানি ড্রাইভস অ্যাওয়ে হোয়াইট মানি ফ্রম মার্কেট, এটা দশকের পর দশক শুনছি। কালো টাকার দাপট-দৌরাত্ম্য সীমাহীন- এভাইে বলা হয়। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রস্তাব করেছেন, যারা বাংলাদেশ থেকে অঢেল অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে গিয়েছেন, তারা এ অর্থ ফেরত আনতে পারে যদি ৭ শতাংশ কর পরিশোধ করেন। এ প্রস্তাব নিয়ে অনেকের আপত্তি এবং তা প্রবল। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, ব্যাংক ডাকাতি করে কেউ যদি অর্থ বাইরে নিয়ে যায় এবং ৭ শতাংশ কর দিয়ে তা ফেরত আনতে চায়, তাকে কি সে অনুমতি দেয়া হবে? কেউ বা তুলছেন পিকে হালদারের কথা। তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা-এমনকি আরও বেশি অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার করেছেন তিনি, এমন জনশ্রুতি রয়েছে। তার মতো আরও অনেক ‘কৃতীপুরুষ’ রয়েছেন, যারা বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করে নানা কৌশলে।

বাংলাদেশ থেকে অর্থ না নিয়েও অর্থপাচার কি সম্ভব? কীভাবে? উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে বিষয়টি। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে এবং ইউরোপ-আমেরিকায় বাংলাদেশের লাখ লাখ কর্মী কাজ করে। তারা কঠোর পরিশ্রম করে এবং আয় করা অর্থের বড় অংশ দেশে পাঠায়। এ জন্য তারা ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত রেট অনুযায়ী তাদের পরিবারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কিছু লোক সক্রিয় (যাদের হুন্ডি চক্র বলা হয়)। তারা প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশের কর্মীদের উপার্জিত ডলার, পাউন্ড, ইউরো, রিয়াল, দিনার সংগ্রহ করে নানা প্রলোভন দেখিয়ে।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে বেশি রেট, সরকারি রেট যদি প্রতি ডলারে ৯০ টাকা হয়, তাহলে এ হুন্ডি চক্র বলে, ‘আমরা ৯২ বা ৯৩ টাকা দেব’। কেউ এক হাজার ডলার তার পরিবারের কাছে পাঠাবে, ব্যাংক দেবে ৯০ হাজার টাকা, হুন্ডি চক্র দেবে ৯২-৯৩ হাজার টাকা এবং সেটা বাড়িতে পৌঁছে দেবে দ্রুততম সময়ে। যারা এভাবে বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করে, তারা সেটা দিয়ে কী করে, সে প্রশ্ন সঙ্গত।

বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি, যেসব দেশে পণ্যের মূল্য বাংলাদেশের চেয়ে কম তা ক্রয় করে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য এ অর্থ ব্যবহার করা হয়। আবার অনেক দেশের ব্যাংকিং নিয়মে ফাঁকফোকরও রয়েছে। যেমন বাড়ি বা গাড়ি কিনলে কোত্থেকে উপার্জন হয়েছে, সেটা জানতে চাওয়া হয় না।

এ অর্থ যে দেশে গচ্ছিত রাখে, সেখানে কর হার কেমন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে অনেক দেশে এ অর্থ ব্ল্যাক মানিতে পরিণত হয়। বাংলাদেশে যারা নমিনি থাকে তাদের টাকায় অর্থ পরিশোধ করা হয়। এ অর্থ আসে কোত্থেকে, সেটা প্রশ্ন বটে। প্রকৃতপক্ষে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দিয়ে এ হুন্ডি ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। কালোটা দিয়েই কালোটাকার ব্যবসা চলে।

আমদানি বাণিজ্য অর্থপাচারের বড় উৎস। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসেই বাংলাদেশের আমদানি ৬১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। গত বছর এ সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার। আমদানির জন্য বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার-পাউন্ড-ইউরো পাঠাতে হয়। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী পণ্যের দাম ও জাহাজ ভাড়া বেশি দেখিয়ে অর্থ পাচার করে, এ অভিযোগ বহু দিনের। একটি গাড়ি কেনা হলো ৫০ হাজার ডলারে, কিন্তু দেখানো হলো ৭০ হাজার ডলার। এভাবে ২০ হাজার ডলার পাচার করা সম্ভব। তবে এর সমপরিমাণ টাকা কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকে জমা রেখেই ডলার নিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে টাকা জমা রেখেই কিন্তু ডলার পাচার করা হয়। এটা ঠেকাতে পারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। কিন্তু যদি অবৈধ আঁতাত গড়ে ওঠে ব্যাংক ও আমদানিকারকের মধ্যে? এটাও মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোতে এখন যত অর্থ গচ্ছিত থাকে, তার ৭৫ ভাগ থাকে বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকে।

অতি ধনবান ব্যক্তিরাই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও বোর্ড মেম্বার হয়ে থাকে। আবার তারাই চেম্বারের নেতা, সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের মালিক। সরকারের ওপরেও এদেও প্রভাব দেখা যায়। জাতীয় সংসদেও ধনবানদের প্রতিপত্তি কম নয়। এ অবস্থায় ব্যাংকের ভেতর থেকে দুর্নীতির রাশ কতটা টানা হবে, তাতে সংশয় থাকেই। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি স্বাধীনভাবে কাজ কতে পারে তাহলে এভাবে আমদানির মাধ্যমে অর্থ পাচার বন্ধ করা যায়।

রফতানির মাধ্যমেও অর্থপাচার হয়ে থাকে। চলতি বছরে বাংলাদেশের রফতানি ৫০ বিলয়ন ডলারে পৌঁছাবে। অনেক রফতানিকারক রফতানি আয় কম দেখিয়ে বিদেশে অর্থ জমা রাখেন- এমন অভিযোগ রয়েছে। এ কাজে ব্যাংকের সহায়তা প্রয়োজন হয়। ঘুষ দিয়ে কিংবা চাপ সৃষ্টি করে এ সুবিধা নেওয়া হয়।

এভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থপাচার ঘটে। বিদেশে বেড়াতে গিয়ে ব্রিফকেস ভর্তি করে যতই ডলার-পাউন্ড নেয়া হোক না কেন তার তুলনায় ঢের বেশি অর্থপাচার হয় ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন বাড়াতে পারলে আমদানি-রফতানির মাধ্যমে অর্থপাচার কমিয়ে আনা সম্ভব। প্রবাসে বাংলাদেশি কর্মীদের প্রতিও বাড়তি সহায়তা বাড়িয়ে দিতে হবে, যেন তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠাতে আগ্রহ বোধ করে।

উন্নত দেশগুলো নীতি-নৈতিকতার কথা বলে। আবার তারাই আমাদের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য বৃত্তি দেয়, শিক্ষাজীবন শেষে বাংলাদেশে ফিরতে দেয় না। যারা প্রবাসে চাকরি করে, উপার্জিত অর্থ দেশে না পাঠিয়ে উন্নত দেশে বাড়ি-বাড়ি কেনায় উৎসাহ দেয়। অনেক দেশ বলে, আমাদের এখানে ১০-২০ লাখ ডলার বিনিয়োগ কর, কীভাবে এ অর্থ উপার্জন করেছ সেটা জানতে চাওয়া হবে না। সুইস ব্যাংকে অঢেল অর্থ জমা রাখলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানতে চায় না,কীভাবে এ অর্থ উপার্জন করা হয়েছে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম তো দশ টাকা টোল দিয়েই স্বর্গে যেতে চাইছেন। কিন্তু যারা উন্নত দেশে পার্মানেন্টলি থেকে যান বাংলাদেশ থেকে গিয়ে, কিংবা আমদানি-রফতানির মাধ্যমে অর্থপাচার করেন উন্নত দেশে আয়েশি জীবন যাপনের জন্য, তারা তো স্বর্গসুখ অনুভব করছেন মর্ত্যে থেকেই। তাদের কে রুখবে?

মোরা কী দুঃখে বাঁচিয়া রব/খালি পেটে পেটে পায়ে হেঁটে হেঁটে স্বর্গে যাব গো, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের দুঃশাসনবিরোধী গণজাগরণের সময়ের গানের কলি। ছোট-বড় নানা সমাবেশে প্যারোডির ঢংয়ে গাইতেন শিল্পীরা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর লবণের সের তিন পয়সা থেকে বাড়তে বাড়তে এক টাকা, এমনকি ১৬ টাকা পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার জন্য আওয়ামী লীগ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের দল, নেজামে ইসলামী প্রভৃতি দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দুই বছর পর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়।

ষাটের দশকেও আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় ‘১২ আনা সের চাল কিনে স্বর্র্গে যাব গো’, ‘নিক্সনের পা ধরে স্বর্গে যাব গো’ এ ধরনের স্লোগান শুনেছি। ‘মোদের আছে ইস্পাহানি, আদমজী-বাওয়ানি, আর আছে সায়গল, মোদের দুঃখ কী আছে বল, এটাও গানের কথা ছিল।

এখন বাংলাদেশে চালের কেজি ৪০-৫০ টাকা হলেও কৃষকের সর্বনাশ হবে। অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে। মজুরি বাড়ছে। ধান চাষের উপকরণ ব্যয় বাড়ছে। চালেল ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ছে। এ সব অর্থনীতির নিয়ম। অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে বলেই নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারছি। বিশ্বব্যাংক এটা পছন্দ করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনেরও এটা পছন্দ নয়। বহু বছর বাংলাদেশ কয়েক লাখ টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও বিশ্বব্যাংক এবং উন্নত দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো। অথচ পদ্মা সেতুর জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে বাংলাদেশের কোষাগার থেকে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম কিংবা রুমিন ফারহানা কেন এ অর্জন স্বীকার করবেন না? বাংলাদেশে দুর্নীতি-অনিয়ম রয়েছে, সেটা আপনাদের জানা আছে। অর্থপাচারও আপনাদের জানা। প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পেছনে দুর্নীতি থাকে, সেটাও জানা। এ সবের বিরুদ্ধেও সোচ্চার থাকুন। একইসঙ্গে বাংলাদেশ যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, তার পক্ষেও থাকুন। পদ্মা সেতু তো মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোরই প্রতীক।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

সূত্র: সময়